, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
সিলেটে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপিত ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে : সাংবাদিক কর্মশালায় বক্তারা জৈন্তাপুরে ব্যবসায়ীর উপর সন্ত্রাসী হামলায় আদালতে মামলা দায়ের ‘সিলেটের পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিত এটা বৈষম্যের শামিল’ অসমর্থ মানুষের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে : জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদুল হাসান নির্বাচনের আগেই বয়কট একাংশের : প্রশ্নবিদ্ধ সিলেট উইমেন চেম্বার সিলেটের ওসমানী হাসপাতালে রোগীর স্বজনকে চিকিৎসকের লাথি মারার ভিডিও ভাইরাল, তদন্তে কমিটি সিলেটে প্রতিবেশীর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপি নেত্রীর পদ স্থগিত আমেরিকা ইউরোপের ৫টি দেশসহ উচ্চ শিক্ষার জন্য তিন সহস্রাধিক রেজিষ্ট্রেশন স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালকের দেওয়ানবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন
বিজ্ঞাপন :
সকল জেলায় সাংবাদিক নিয়োগ চলছে
আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা

২০ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনের যাবজ্জীবন হাইকোর্টে বহাল

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ আসামির মৃত্যুদ- এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবনের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি নিয়ে গতকাল রবিবার বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন।

রায়ের পর আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। তবে ভবিষ্যতে যেন আর কোনো আবরারকে জীবন দিতে না হয়, সেই পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে র‌্যাগিংমুক্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘে পড়াশোনা করতে পারেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের দেওয়া ২০ জনের মৃত্যুদন্ড এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল রেখেছেন। তাদের মধ্যে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত চারজন পলাতক রয়েছেন। আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, নিম্ন আদালত যে ফাইন্ডিংস দিয়েছেন, এখানে ইন্টারফেয়ারের কিছু নেই।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমার পাশে আবরারের বাবা আছেন, উনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন, গোটা জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে ডিসিপ্লিন আনার জন্য, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের যে ধারণা, সেই ধারণাটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে বার্তা গেল যে, আপনি যতই শক্তিশালী হোন না কেন, পেছনে যত শক্তিই থাকুক না কেন, সত্য ও ন্যায়বিচার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘মাও সেতুংয়ের মতে, কোনো কোনো মৃত্যু হয় পাহাড়ের মতো ভারী, আর কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা। আবরারের মৃত্যু আমাদের কাছে পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে আছে। গোটা জাতির মূল্যবোধের শিকড়ে নাড়া দিয়েছে। আবরার ফাহাদের মৃত্যু প্রকাশ করেছে যে, রাজনৈতিক ফ্যাসিজম দিন দিন কীভাবে বাড়তে পারে। একই সাথে আবরারের মৃত্যু আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছে যে, ফ্যাসিজম যত শক্তিশালীই হোক, মানুষের মনুষ্যত্ববোধ কখনও কখনও জেগে উঠবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবরার ফাহাদ তার জীবন দিয়ে অসংখ্য মেধাবী ছাত্রের জীবন রক্ষা করে গেছেন- মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়ার কারণে আবরার ফাহাদের বিচার নিশ্চিত হয়েছে।

আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ছেলেমেয়েরা যদি বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বাবা-মা কষ্ট পেয়ে থাকে। ছাত্রদের কাছে আবেদন থাকবে, তারা যেন এসব খারাপ রাজনীতিতে জড়িত না হন।

মৃত্যুদন্ডের ২০ আসামি

বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এসএম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) ও এসএম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।

যাবজ্জীবনের পাঁচ আসামি

বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।

পলাতক চার আসামি

মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল জিসান ও মুজতবা রাফিদ।

ফিরে দেখা

আবরার ফাহাদ ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। ফেসবুক পোস্টে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন আবরার। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর আবরারকে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফেসবুক পোস্টের সূত্র ধরে আবরারকে ডেকে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায়। ভোরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন। তাদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, আবরার হত্যার আসামিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং হলগুলোতে নির্যাতন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিষয়টি তদন্ত করে ১২ জন কর্মীকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ।

আবরার হত্যার পরের দিন ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর তার বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে। পাঁচ সপ্তাহ তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেন, সেখানে আসামি করা হয় মোট ২৫ জনকে। অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক চার আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। তাদের মধ্যে একজন পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে মামলাটি পরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ স্থানান্তর করে আদেশ জারি হয়। বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এ মামলার বাদী ও আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর আদালতে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ৬০ সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। কারাগারে থাকা ২২ আসামি আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তিন আসামি পলাতক থাকায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। এরপর কয়েকজন আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দেন। এ মামলার চার্জ গঠনের সময় শব্দগত ত্রুটি থাকায় ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষ তা সংশোধনের আবেদন করে। পরের দিন ২৫ আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ গঠন করে আদালত। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর দুইপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেওয়া হয়। রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদ- এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি ৬ হাজার ৬২৭ পৃষ্ঠার ডেথ রেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়। এরপর আসামিরা দ- থেকে খালাস চেয়ে ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-? দেওয়া হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। দ-িত আসামিরা উচ্চ আদালতে ফৌজদারি আপিল এবং জেল আপিল করতে পারেন।

গত ৬ আগস্ট মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মুনতাসির আল জেমি গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দেওয়াল ভেঙে পালিয়ে যান। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বুয়েটে বিক্ষোভ করেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি দ্রুত শুরুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এরপর শুনানি শেষে গতকাল আপিলের রায় ঘোষণা করা হয়।

রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আবরারের ছোট ভাই বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ। যত দ্রুত সম্ভব রায় বাস্তবায়ন করে এটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করার জন্য আদালতের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি মুনতাসির আল জেমির পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে হতাশা প্রকাশ করে ফাইয়াজ বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেকে পালিয়েছে। কিন্তু এমন একজন আসামি, যিনি আবরার ফাহাদকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছয় মাস পরে কেন জানানো হলো, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।

জনপ্রিয়

সিলেটে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপিত

আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা

২০ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনের যাবজ্জীবন হাইকোর্টে বহাল

প্রকাশের সময় : ১১:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ আসামির মৃত্যুদ- এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবনের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি নিয়ে গতকাল রবিবার বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন।

রায়ের পর আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। তবে ভবিষ্যতে যেন আর কোনো আবরারকে জীবন দিতে না হয়, সেই পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে র‌্যাগিংমুক্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘে পড়াশোনা করতে পারেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের দেওয়া ২০ জনের মৃত্যুদন্ড এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল রেখেছেন। তাদের মধ্যে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত চারজন পলাতক রয়েছেন। আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, নিম্ন আদালত যে ফাইন্ডিংস দিয়েছেন, এখানে ইন্টারফেয়ারের কিছু নেই।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমার পাশে আবরারের বাবা আছেন, উনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন, গোটা জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে ডিসিপ্লিন আনার জন্য, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের যে ধারণা, সেই ধারণাটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে বার্তা গেল যে, আপনি যতই শক্তিশালী হোন না কেন, পেছনে যত শক্তিই থাকুক না কেন, সত্য ও ন্যায়বিচার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘মাও সেতুংয়ের মতে, কোনো কোনো মৃত্যু হয় পাহাড়ের মতো ভারী, আর কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা। আবরারের মৃত্যু আমাদের কাছে পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে আছে। গোটা জাতির মূল্যবোধের শিকড়ে নাড়া দিয়েছে। আবরার ফাহাদের মৃত্যু প্রকাশ করেছে যে, রাজনৈতিক ফ্যাসিজম দিন দিন কীভাবে বাড়তে পারে। একই সাথে আবরারের মৃত্যু আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছে যে, ফ্যাসিজম যত শক্তিশালীই হোক, মানুষের মনুষ্যত্ববোধ কখনও কখনও জেগে উঠবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবরার ফাহাদ তার জীবন দিয়ে অসংখ্য মেধাবী ছাত্রের জীবন রক্ষা করে গেছেন- মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়ার কারণে আবরার ফাহাদের বিচার নিশ্চিত হয়েছে।

আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ছেলেমেয়েরা যদি বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বাবা-মা কষ্ট পেয়ে থাকে। ছাত্রদের কাছে আবেদন থাকবে, তারা যেন এসব খারাপ রাজনীতিতে জড়িত না হন।

মৃত্যুদন্ডের ২০ আসামি

বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এসএম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) ও এসএম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।

যাবজ্জীবনের পাঁচ আসামি

বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।

পলাতক চার আসামি

মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল জিসান ও মুজতবা রাফিদ।

ফিরে দেখা

আবরার ফাহাদ ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। ফেসবুক পোস্টে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন আবরার। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর আবরারকে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফেসবুক পোস্টের সূত্র ধরে আবরারকে ডেকে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায়। ভোরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন। তাদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, আবরার হত্যার আসামিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং হলগুলোতে নির্যাতন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিষয়টি তদন্ত করে ১২ জন কর্মীকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ।

আবরার হত্যার পরের দিন ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর তার বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে। পাঁচ সপ্তাহ তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেন, সেখানে আসামি করা হয় মোট ২৫ জনকে। অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক চার আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। তাদের মধ্যে একজন পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে মামলাটি পরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ স্থানান্তর করে আদেশ জারি হয়। বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এ মামলার বাদী ও আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর আদালতে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ৬০ সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। কারাগারে থাকা ২২ আসামি আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তিন আসামি পলাতক থাকায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। এরপর কয়েকজন আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দেন। এ মামলার চার্জ গঠনের সময় শব্দগত ত্রুটি থাকায় ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষ তা সংশোধনের আবেদন করে। পরের দিন ২৫ আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ গঠন করে আদালত। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর দুইপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেওয়া হয়। রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদ- এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি ৬ হাজার ৬২৭ পৃষ্ঠার ডেথ রেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়। এরপর আসামিরা দ- থেকে খালাস চেয়ে ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-? দেওয়া হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। দ-িত আসামিরা উচ্চ আদালতে ফৌজদারি আপিল এবং জেল আপিল করতে পারেন।

গত ৬ আগস্ট মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মুনতাসির আল জেমি গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দেওয়াল ভেঙে পালিয়ে যান। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বুয়েটে বিক্ষোভ করেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি দ্রুত শুরুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এরপর শুনানি শেষে গতকাল আপিলের রায় ঘোষণা করা হয়।

রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আবরারের ছোট ভাই বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ। যত দ্রুত সম্ভব রায় বাস্তবায়ন করে এটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করার জন্য আদালতের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি মুনতাসির আল জেমির পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে হতাশা প্রকাশ করে ফাইয়াজ বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেকে পালিয়েছে। কিন্তু এমন একজন আসামি, যিনি আবরার ফাহাদকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছয় মাস পরে কেন জানানো হলো, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।