, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
সিলেটে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপিত ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে : সাংবাদিক কর্মশালায় বক্তারা জৈন্তাপুরে ব্যবসায়ীর উপর সন্ত্রাসী হামলায় আদালতে মামলা দায়ের ‘সিলেটের পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিত এটা বৈষম্যের শামিল’ অসমর্থ মানুষের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে : জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদুল হাসান নির্বাচনের আগেই বয়কট একাংশের : প্রশ্নবিদ্ধ সিলেট উইমেন চেম্বার সিলেটের ওসমানী হাসপাতালে রোগীর স্বজনকে চিকিৎসকের লাথি মারার ভিডিও ভাইরাল, তদন্তে কমিটি সিলেটে প্রতিবেশীর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপি নেত্রীর পদ স্থগিত আমেরিকা ইউরোপের ৫টি দেশসহ উচ্চ শিক্ষার জন্য তিন সহস্রাধিক রেজিষ্ট্রেশন স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালকের দেওয়ানবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন
বিজ্ঞাপন :
সকল জেলায় সাংবাদিক নিয়োগ চলছে

সুরমা-কুশিয়ারায় নতুন ভাঙন : বাংলাদেশের জায়গায় ভারতের চাষাবাদ

সিলেটের জকিগঞ্জে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অর্ধশতাধিক স্থানের ডাইক অরক্ষিত। ভারতের সীমান্তরক্ষী ফোর্স-বিএসএফের বাধায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব স্থানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (ডাইক) মেরামত করতে পারছে না। ফলে গত বছরের কয়েকদফা বন্যার ধকল কাটার আগেই চলতি বছরে আবারও ভয়াবহ বন্যা হতে পারে। এ নিয়ে জনমনে চরম উদ্বেগ আতঙ্ক বিরাজ করছে।

কয়েক বছরের ভাঙনে সুরমা-কুশিয়ারা নদী এখন বাংলাদেশ সীমান্তের অন্তত এক কিলোমিটার ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে। নদীর ভাঙন দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে নদী ভাঙনে বাংলাদেশের হাজার হাজার একর জায়গা ভারতের দখলে গেছে। এসব জায়গায় ভারতীয়রা চাষাবাদ করছে।

সম্প্রতি সুরমা-কুশিয়ারার বেড়িবাঁধের (ডাইকের) সংস্কারের দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করেছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও লিখিতভাবে আশু পদক্ষেপ কামনা করেছেন। লন্ডনে বসবাসরত জকিগঞ্জী নাগরিকরাও সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে ভারতের অযাচিত বাধার বিষয় উল্লেখ করে প্রতিকার কামনা করেছেন।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারার বেড়িবাঁধের (ডাইকের) অন্তত ৪৫/৫০টি স্থান ভেঙে পানি প্রবেশ করে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি হয় সীমান্তের এ জনপদে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি ফসলি জমিসহ রাস্তাঘাট। ভয়াবহ বন্যার ক্ষতচিহ্ন এখনো রয়েছে গ্রামগঞ্জে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয় পাউবো। দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শুরু হলে বাধা দেয় ভারতের সীমান্তরক্ষী ফোর্স-বিএসএফ। দফায় দফায় বাধার মুখে বন্ধ হয়ে যায় বাঁধ মেরামতের কাজ। এতে আটকে যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ।

এলাকাবাসী জানান, বিগত বন্যার পরে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি হ্রাস পাওয়ার পরে নতুন করে জকিগঞ্জ পৌরসভার মাইজকান্দি, সদর ইউপির ছবড়িয়া, বাখরশাল, শষ্যকুঁড়ি, মানিকপুর, লালোগ্রাম, ফেউয়াসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ডাইকের আশপাশের মাটি ধসে নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানের ডাইক মারাত্মক ঝূঁকিপূর্ণ। অনেক জায়গায় অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বিশেষ করে গত বছরের বন্যায় যে সকল এলাকার ডাইক ভেঙে কয়েকদফায় বন্যা সৃষ্টি হয়েছিলো সেই ডাইকগুলো মেরামত করা হয়নি। বন্যার সময় ডাইকে বালুভর্তি বস্তা ফেলে এলাকার লোকজন পানি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ভাঙা ডাইকে এখনো গত বছরের বালুভর্তি বস্তা ফেলে রাখা আছে। এর মাঝে বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দেওয়ায় জনমনে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাধায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত ও ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না হওয়ায় আগামী বর্ষায় ভারতের উজানের নেমে আসা ঢলে বছরজুড়ে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন জকিগঞ্জের নদীপাড়ের বাসিন্দারা।

নদীর তীরবর্তী এলাকার লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, কয়েক বছরের ভাঙনে সুরমা-কুশিয়ারা নদী এখন বাংলাদেশ সীমান্তের অন্তত এক-দুই কিলোমিটার ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে। নদীর ভাঙন দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে নদী ভাঙনে বাংলাদেশের হাজার হাজার একর জায়গা ভারতের দখলে গেছে। এরপরও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছেনা। ভাঙন কবলিত এলাকায় কয়েকদিন পর পর পাউবোর কর্মকর্তাগণ এসে ভাঙনের ছবি-ভিডিও নিয়ে যান কিন্তু সরেজমিনে কোন কাজ হয়না। নানা অজুহাতে বছরের পর বছর অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে ভারতের সীমান্তবর্তী ডাইক। কয়েক বছরে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে হাজারো পরিবার বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইতোমধ্যে হাটবাজার, ঘরবাড়ী, গাছপালা, জায়গাজমি, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে সুরমা-কুশিয়ারার গর্ভে। ভূমিহীনরা যাযাবরের মত জীবনযাপন করছেন। কিছু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার না করায় পানির বিপদসীমার স্তরের নিচে নেমে গেছে ডাইক। এতে বর্ষা মৌসুমে বাঁধ উপচে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে ডাইক ভেঙে যায়। গত বছরে বরাক নদী থেকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে উজানের ঢল নেমে জকিগঞ্জে টানা চারবার বন্যা সৃষ্টি হয়েছিলো। এবারও জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে জকিগঞ্জ সদর ইউপির ছবড়িয়া গ্রামের ডাইক পুরোপুরি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বিএসএফের বাধায় ডাইকের কাজ বন্ধ রয়েছে। বর্ষার আগে ভারতীয় বাধা উপেক্ষা করে ডাইক মেরামত না করলে বানের পানিতে ডুববে জকিগঞ্জ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ডান তীরে ৪১ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এর মধ্যে ভক্তিপুরে ৫০০ মিটার, মানিকপুর বাখরশালে ৮০০ মিটার, শষ্যকুঁড়িতে ৭০০ মিটার, শেখপাড়ায় ২৫০ মিটার, উজিরপুরে ৪০০ মিটার, লক্ষীরারচকে ৫৫০ মিটার, সুনাপুরে ৪০০ মিটার, সুপ্রাকান্দিতে ৪০০ মিটার, গাগলাজুরে ২০০ মিটার, লোহার মহলে ৩৫০ মিটারসহ ১০টি স্থানে প্রায় ৪ দশমিক ৬০ কি.মি। জকিগঞ্জ উপজেলায় ‘সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চারটি প্যাকেজে সুপ্রাকান্দি, মানিকপুর, রারাই সেনাপতির চক, বড়চালিয়া ও রহিমপুর নামক স্থানে ১ দশমিক ৮০০ কি.মি. নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের মধ্যে দুটি প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে। অপরটি চলমান। এছাড়া ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ার নদীর ডান তীরে ৪১ কি.মি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুনর্বাসন কাজ ও অতি ভাঙনপ্রবণ এলাকায় নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ইতোমধ্যে ৪৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায়।

ভাঙন রোধের জন্য জরুরি ভিত্তিতে এখন কুশিয়ারা নদীর ছয় কিলোমিটার এলাকায় ব্লক বসাতে হবে। এর জন্য ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। গত বছরের বন্যার পর নতুন করে কয়েক কিলোমিটার জায়গা সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে বিলিন হয়েছে। পাউবো’র ওই সূত্র আরও জানায়, কুশিয়ারার ৪১ কিলোমিটার ও সুরমার ২৫ কিলোমিটার আন্তসীমান্ত নদী। আইন অনুযায়ী সীমান্তের ১৫০ গজের ভিতরে কৃষি কাজ, মাছ আহরণ ও পানি ব্যবহারসহ কিছু কাজ করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু স্থাপনা নির্মাণের কোনো বিধান নেই। তবে অতীতে নদীর বাঁধ নির্মাণের কাজে কখনো বিএসএফ বাধা দেয়নি। বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারার যেসব স্থানে ভাঙন দেখা দেয় শুষ্ক মৌসুমে পাউবো সেসব স্থানে মাটি ফেলে বাঁধ নির্মাণের কাজ করে। কিন্তু এ বছর বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলে বিএসএফ বাধা দেয়। কোনোভাবেই তারা বাঁধ মেরামতের জন্য মাটি ফেলতে দেয়নি।

জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ তাপাদার জানান, কুশিয়ারা নদীর ছবড়িয়া, ছয়লেন, মাইজকান্দি, শষ্যকুঁড়ি, বাখরশাল, মানিকপুর, রারাই এবং সুরমা নদীর বাল্লা, শরীফাবাদ ও হাজীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ গত বছরের বন্যার সময় ভেঙে ছিলো। এখনো সেই বাঁধগুলো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বিএসএফের বাধার কারণে বাঁধ মেরামত করতে না পারায় আগামী বর্ষায় ভারতের উজানের ঢল নামলে বিনা বাধায় পানি ঢুকবে বিভিন্ন এলাকা দিয়ে। এতে উপজেলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হবে। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ফসলহানি ঘটবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, ভারতের সীমান্তরক্ষী ফোর্স-বিএসএফের বাধার কারণে সুরমা ও কুশিয়ারার অন্তত ৩০টি স্থানে বাঁধ নির্মাণের কাজ করা যাচ্ছে না। এক্সেভেটর ও ড্রাম ট্রাক নিয়ে বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ করতে গেলেই বিএসএফ বাধা দিচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

জনপ্রিয়

সিলেটে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপিত

সুরমা-কুশিয়ারায় নতুন ভাঙন : বাংলাদেশের জায়গায় ভারতের চাষাবাদ

প্রকাশের সময় : ১০:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

সিলেটের জকিগঞ্জে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অর্ধশতাধিক স্থানের ডাইক অরক্ষিত। ভারতের সীমান্তরক্ষী ফোর্স-বিএসএফের বাধায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব স্থানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (ডাইক) মেরামত করতে পারছে না। ফলে গত বছরের কয়েকদফা বন্যার ধকল কাটার আগেই চলতি বছরে আবারও ভয়াবহ বন্যা হতে পারে। এ নিয়ে জনমনে চরম উদ্বেগ আতঙ্ক বিরাজ করছে।

কয়েক বছরের ভাঙনে সুরমা-কুশিয়ারা নদী এখন বাংলাদেশ সীমান্তের অন্তত এক কিলোমিটার ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে। নদীর ভাঙন দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে নদী ভাঙনে বাংলাদেশের হাজার হাজার একর জায়গা ভারতের দখলে গেছে। এসব জায়গায় ভারতীয়রা চাষাবাদ করছে।

সম্প্রতি সুরমা-কুশিয়ারার বেড়িবাঁধের (ডাইকের) সংস্কারের দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করেছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও লিখিতভাবে আশু পদক্ষেপ কামনা করেছেন। লন্ডনে বসবাসরত জকিগঞ্জী নাগরিকরাও সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে ভারতের অযাচিত বাধার বিষয় উল্লেখ করে প্রতিকার কামনা করেছেন।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারার বেড়িবাঁধের (ডাইকের) অন্তত ৪৫/৫০টি স্থান ভেঙে পানি প্রবেশ করে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি হয় সীমান্তের এ জনপদে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি ফসলি জমিসহ রাস্তাঘাট। ভয়াবহ বন্যার ক্ষতচিহ্ন এখনো রয়েছে গ্রামগঞ্জে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয় পাউবো। দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শুরু হলে বাধা দেয় ভারতের সীমান্তরক্ষী ফোর্স-বিএসএফ। দফায় দফায় বাধার মুখে বন্ধ হয়ে যায় বাঁধ মেরামতের কাজ। এতে আটকে যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ।

এলাকাবাসী জানান, বিগত বন্যার পরে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি হ্রাস পাওয়ার পরে নতুন করে জকিগঞ্জ পৌরসভার মাইজকান্দি, সদর ইউপির ছবড়িয়া, বাখরশাল, শষ্যকুঁড়ি, মানিকপুর, লালোগ্রাম, ফেউয়াসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ডাইকের আশপাশের মাটি ধসে নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানের ডাইক মারাত্মক ঝূঁকিপূর্ণ। অনেক জায়গায় অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বিশেষ করে গত বছরের বন্যায় যে সকল এলাকার ডাইক ভেঙে কয়েকদফায় বন্যা সৃষ্টি হয়েছিলো সেই ডাইকগুলো মেরামত করা হয়নি। বন্যার সময় ডাইকে বালুভর্তি বস্তা ফেলে এলাকার লোকজন পানি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ভাঙা ডাইকে এখনো গত বছরের বালুভর্তি বস্তা ফেলে রাখা আছে। এর মাঝে বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দেওয়ায় জনমনে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাধায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত ও ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না হওয়ায় আগামী বর্ষায় ভারতের উজানের নেমে আসা ঢলে বছরজুড়ে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন জকিগঞ্জের নদীপাড়ের বাসিন্দারা।

নদীর তীরবর্তী এলাকার লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, কয়েক বছরের ভাঙনে সুরমা-কুশিয়ারা নদী এখন বাংলাদেশ সীমান্তের অন্তত এক-দুই কিলোমিটার ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে। নদীর ভাঙন দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে নদী ভাঙনে বাংলাদেশের হাজার হাজার একর জায়গা ভারতের দখলে গেছে। এরপরও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছেনা। ভাঙন কবলিত এলাকায় কয়েকদিন পর পর পাউবোর কর্মকর্তাগণ এসে ভাঙনের ছবি-ভিডিও নিয়ে যান কিন্তু সরেজমিনে কোন কাজ হয়না। নানা অজুহাতে বছরের পর বছর অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে ভারতের সীমান্তবর্তী ডাইক। কয়েক বছরে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে হাজারো পরিবার বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইতোমধ্যে হাটবাজার, ঘরবাড়ী, গাছপালা, জায়গাজমি, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে সুরমা-কুশিয়ারার গর্ভে। ভূমিহীনরা যাযাবরের মত জীবনযাপন করছেন। কিছু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার না করায় পানির বিপদসীমার স্তরের নিচে নেমে গেছে ডাইক। এতে বর্ষা মৌসুমে বাঁধ উপচে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে ডাইক ভেঙে যায়। গত বছরে বরাক নদী থেকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে উজানের ঢল নেমে জকিগঞ্জে টানা চারবার বন্যা সৃষ্টি হয়েছিলো। এবারও জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে জকিগঞ্জ সদর ইউপির ছবড়িয়া গ্রামের ডাইক পুরোপুরি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বিএসএফের বাধায় ডাইকের কাজ বন্ধ রয়েছে। বর্ষার আগে ভারতীয় বাধা উপেক্ষা করে ডাইক মেরামত না করলে বানের পানিতে ডুববে জকিগঞ্জ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ডান তীরে ৪১ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এর মধ্যে ভক্তিপুরে ৫০০ মিটার, মানিকপুর বাখরশালে ৮০০ মিটার, শষ্যকুঁড়িতে ৭০০ মিটার, শেখপাড়ায় ২৫০ মিটার, উজিরপুরে ৪০০ মিটার, লক্ষীরারচকে ৫৫০ মিটার, সুনাপুরে ৪০০ মিটার, সুপ্রাকান্দিতে ৪০০ মিটার, গাগলাজুরে ২০০ মিটার, লোহার মহলে ৩৫০ মিটারসহ ১০টি স্থানে প্রায় ৪ দশমিক ৬০ কি.মি। জকিগঞ্জ উপজেলায় ‘সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চারটি প্যাকেজে সুপ্রাকান্দি, মানিকপুর, রারাই সেনাপতির চক, বড়চালিয়া ও রহিমপুর নামক স্থানে ১ দশমিক ৮০০ কি.মি. নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের মধ্যে দুটি প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে। অপরটি চলমান। এছাড়া ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ার নদীর ডান তীরে ৪১ কি.মি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুনর্বাসন কাজ ও অতি ভাঙনপ্রবণ এলাকায় নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ইতোমধ্যে ৪৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায়।

ভাঙন রোধের জন্য জরুরি ভিত্তিতে এখন কুশিয়ারা নদীর ছয় কিলোমিটার এলাকায় ব্লক বসাতে হবে। এর জন্য ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। গত বছরের বন্যার পর নতুন করে কয়েক কিলোমিটার জায়গা সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে বিলিন হয়েছে। পাউবো’র ওই সূত্র আরও জানায়, কুশিয়ারার ৪১ কিলোমিটার ও সুরমার ২৫ কিলোমিটার আন্তসীমান্ত নদী। আইন অনুযায়ী সীমান্তের ১৫০ গজের ভিতরে কৃষি কাজ, মাছ আহরণ ও পানি ব্যবহারসহ কিছু কাজ করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু স্থাপনা নির্মাণের কোনো বিধান নেই। তবে অতীতে নদীর বাঁধ নির্মাণের কাজে কখনো বিএসএফ বাধা দেয়নি। বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারার যেসব স্থানে ভাঙন দেখা দেয় শুষ্ক মৌসুমে পাউবো সেসব স্থানে মাটি ফেলে বাঁধ নির্মাণের কাজ করে। কিন্তু এ বছর বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলে বিএসএফ বাধা দেয়। কোনোভাবেই তারা বাঁধ মেরামতের জন্য মাটি ফেলতে দেয়নি।

জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ তাপাদার জানান, কুশিয়ারা নদীর ছবড়িয়া, ছয়লেন, মাইজকান্দি, শষ্যকুঁড়ি, বাখরশাল, মানিকপুর, রারাই এবং সুরমা নদীর বাল্লা, শরীফাবাদ ও হাজীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ গত বছরের বন্যার সময় ভেঙে ছিলো। এখনো সেই বাঁধগুলো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বিএসএফের বাধার কারণে বাঁধ মেরামত করতে না পারায় আগামী বর্ষায় ভারতের উজানের ঢল নামলে বিনা বাধায় পানি ঢুকবে বিভিন্ন এলাকা দিয়ে। এতে উপজেলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হবে। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ফসলহানি ঘটবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, ভারতের সীমান্তরক্ষী ফোর্স-বিএসএফের বাধার কারণে সুরমা ও কুশিয়ারার অন্তত ৩০টি স্থানে বাঁধ নির্মাণের কাজ করা যাচ্ছে না। এক্সেভেটর ও ড্রাম ট্রাক নিয়ে বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ করতে গেলেই বিএসএফ বাধা দিচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।